১১ অক্টোবর ২০২৫ - ০৯:৩৩
ফিলিস্তিন ইস্যুতে বিশ্বকে এক হওয়ার আহ্বান শহিদুল আলমের।

ইসরাইলের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে মানবাধিকারকর্মী ও বিশিষ্ট আলোকচিত্রী ড. শহিদুল আলম আবারও মানবতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিলেন।

আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): মানবাধিকারকর্মী ও বিশিষ্ট আলোকচিত্রী ড. শহিদুল আলম আবারও মানবতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিলেন। তিনি বলেন, “গাজা এখনো মুক্ত হয়নি, তাই আমাদের সংগ্রাম শেষ নয়।” শনিবার (১১ অক্টোবর) ভোর ৪টা ৫৫ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে এই বার্তা দেন তিনি।


বিমানবন্দরে নামার পর শহিদুল আলমকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন পরিবারের সদস্য, সহকর্মী, মানবাধিকার কর্মী, শিল্পী ও সাংবাদিকরা। দীর্ঘ কয়েক সপ্তাহ বন্দিদশায় থাকার পর দেশে ফিরে তিনি আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, “আমি বেঁচে ফিরেছি, কিন্তু গাজার অসংখ্য মানুষ এখনো মৃত্যুর মুখে। আমাদের কাজ এখনো শেষ হয়নি। ফিলিস্তিন স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববাসীকে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।”

গত মাসে ‘কনশানস’ (Conscience) জাহাজে মানবিক সহায়তা বহন করে গাজার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া একদল আন্তর্জাতিক সাংবাদিক, স্বাস্থ্যকর্মী ও মানবাধিকারকর্মীকে ইসরাইলি দখলদার বাহিনী অপহরণ করে। তাদের মধ্যে ছিলেন ড. শহিদুল আলমও।

জাহাজটি গাজায় অবরুদ্ধ মানুষদের খাদ্য ও ওষুধ পৌঁছে দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক সমুদ্রে প্রবেশের পরই ইসরাইলি নৌবাহিনী সেটি আটকে ফেলে এবং সকল যাত্রীকে জোর করে তেল আবিবে নিয়ে যায়।

শহিদুল আলমকে ইসরাইলের একটি গোপন স্থানে একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বলে তার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে। কয়েক দিন পর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। প্রায় দুই সপ্তাহ আটক থাকার পর আন্তর্জাতিক চাপ ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে তার মুক্তি নিশ্চিত হয়।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি তদারকি করেন। তার দপ্তর থেকে জর্ডান, মিশর ও তুরস্কে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগের নির্দেশ দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল—শহিদুল আলমসহ আটক সকল সাংবাদিক ও মানবিক কর্মীর নিরাপত্তা ও দ্রুত মুক্তি নিশ্চিত করা।

মুক্তির পর ড. ইউনূস এক বিবৃতিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান-এর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, “তুরস্ক যে মানবিক ভূমিকা নিয়েছে, তা বাংলাদেশের জনগণ গভীরভাবে স্মরণ রাখবে। শহিদুল আলমের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন আমাদের কূটনৈতিক ঐক্যের সাফল্য।”

মুক্তি পাওয়ার পর বৃহস্পতিবার সকালে তেল আবিব থেকে তুরস্কে পৌঁছান শহিদুল আলম। সেখান থেকে পরবর্তী ফ্লাইটে ঢাকায় আসেন তিনি। তুরস্কে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানান এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করেন।

বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলাপে শহিদুল আলম বলেন, “আমাদের বিরুদ্ধে যে অন্যায় হয়েছে, তা গাজার মানুষের কষ্টের কাছে কিছুই নয়। গাজা আজ এক খোলা কারাগার। শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে, হাসপাতাল ধ্বংস করা হচ্ছে। আমরা যারা মানবতার পক্ষে কাজ করি, তাদের দায়িত্ব এখন আরও বেড়ে গেছে।”

তিনি আরও বলেন, “আমি ইসরাইলি কারাগারে থেকেও দেখেছি, কীভাবে তারা সত্যকে দমন করতে চায়। সাংবাদিকদের ভয় দেখানো, ছবি তোলা নিষিদ্ধ করা—সবই সেই ভয়ানক বাস্তবতার অংশ। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, সত্যকে কখনো বন্দি করা যায় না।”

শহিদুল আলমের মুক্তির দাবিতে আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। তারা শহিদুল আলমসহ আটক সকল মানবিক কর্মীর মুক্তি দাবি করে বিবৃতি দেয়।

বাংলাদেশের বিভিন্ন নাগরিক সমাজ, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও তার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন, অনলাইন প্রচারণা ও প্রার্থনা সভা আয়োজন করে।

দেশে ফিরে শহিদুল আলম বলেন, “গাজায় চলমান হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে বিশ্বকে এক হতে হবে। এটি শুধু ফিলিস্তিনিদের লড়াই নয়, এটি মানবতার লড়াই।”

তিনি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে আহ্বান জানান যেন তারা ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধের চিত্র আরও বেশি করে তুলে ধরে।

তিনি বলেন, “আমরা যেসব ছবি তুলেছি, যেসব ভিডিও ধারণ করেছি—সবই ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে থাকবে। ফিলিস্তিনের শিশুরা আমাদের দিকে চেয়ে আছে। তারা ন্যায়ের পক্ষে পৃথিবীর মানুষদের দেখতে চায়।”

ড. শহিদুল আলম শুধু একজন আলোকচিত্রী নন, বরং বাংলাদেশের নাগরিক সমাজে ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের এক প্রতীক। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়ও সরকারবিরোধী মন্তব্যের কারণে তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং পরে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর চাপে মুক্তি পান।

এইবার ইসরাইলি কারাগার থেকে ফিরে তিনি আবারও প্রমাণ করলেন—মানবতার পক্ষে অবস্থান নেওয়া কোনো অপরাধ নয়, বরং এটি একজন নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব।

Tags

Your Comment

You are replying to: .
captcha